নকশিকাঁথা বাংলাদেশের লোকশিল্পের সবচেয়ে আকর্ষণীয় নিদর্শন। শীতকালে গায়ে দেওয়ার জন্য কাপড় কয়েক পরত একসঙ্গে সাজিয়ে কাঁথা সেলাই করা হয়। এর মধ্যে কিছু কাঁথা তৈরি করা হয় নানা রঙের সুতায়, নানারকম নকশা করে। অনেক নকশা দিয়ে যে কাঁথা সেলাই হয় সেটাই হলো নকশিকাঁথা। গাঁয়ের মেয়েরা কাজের অবসরে দিনের পর দিন খেটে সুই-সুতায়, রং-বেরঙের ছবি ও নকশা
কাঁথায় ফুটিয়ে তোলে। এসব ছবিতে থাকে অনেক গল্প, অনেক কাহিনি। গাঁয়ের বধূ তার নিজের জীবনের সুখ-দুঃখের কথা সুঁই-সুতার ছবির মধ্য দিয়ে ফুটিয়ে তোলে। এক-একটি কাঁথা বানাতে এক বছর, কখনো কখনো দুই বছর সময় পেরিয়ে যায়। এক-একটি কাঁথার শিল্পনৈপুণ্য দেখে বিস্মিত হতে হয়। কাঁথাতে যেসব নকশা থাকে তা হলো- ফুল, পাতা, গাছ-পালা, পদ্ম, চাঁদ, তারা, পাখি, মাছ, নানারকম জীবজন্তু এমনকি ঘরবাড়ি ইত্যাদি। আবার কিছু কিছু কাঁথাতে রেখা, বৃত্ত, গোলাকার ঘর, তিনকোনা ঘর এসব আদল বারবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ব্যবহার করা হয়। একই আদল বা নকশার বারবার ব্যবহারকে 'মোটিফ' বলে। ব্যবহারিক দিক থেকে নকশিকাঁথাকে বিভিন্ন শ্রেণিতে ভাগ করা যায়। যেমন-
সুজনিপেড়ে, লেপকাঁথা, চাদর কাঁথা, জায়নামাজ, আসন কাঁথা, পালকির কাঁথা, রুমাল কাঁথা ইত্যাদি। বাংলাদেশে নকশিকাঁথা সেলাইয়ের দুটি মূলধারা বা রীতি আছে। তার একটি হলো যশোর রীতি, অন্যটি রাজশাহী রীতি।
তাছাড়াও চট্টগ্রাম, খুলনা, ফরিদপুর প্রভৃতি অঞ্চলেও নকশিকাঁথার উল্লেখযোগ্য ধারা আছে। যশোর অঞ্চলের নকশিকাঁথা বাংলাদেশের শীর্ষস্থানে অবস্থিত। এ অঞ্চলের কাঁথার ফোঁড় অত্যন্ত সূক্ষ্ম, রং রুচিসম্মত। গ্রামীণ মেলায় এই কাঁথা কোনোদিন বিক্রি হয় না। নিজেদের উদ্দেশ্যে এই কাঁথা তৈরি হয়। তবে অপরের ফরমাসে পারিশ্রমিকের বিনিময়েও নকশিকাঁথা তৈরি করা হয়। আজকাল শহরের কারুশিল্পের দোকানে নকশিকাঁথা বেচাকেনা হতে দেখা যায়। এমনকি বিদেশের বাজারেও আমাদের এই ঐতিহ্যবাহী শিল্পের বিক্রয় হয়ে থাকে।
পোড়ামাটির ফলকচিত্র বা টেরাকোটা
পোড়ামাটির ফলক বাংলাদেশের আদি ঐতিহ্যবাহী লোকশিল্প এবং খুবই বিখ্যাত। মধ্যযুগে বিভিন্ন ভবন ও স্থাপনাতে, বিশেষ করে মন্দির, মসজিদ ইত্যাদির দেয়ালে এ ফলকচিত্র ব্যবহার করা হতো। পোড়ামাটির ফলকচিত্র বা Terracotta হচ্ছে মাটির পাটাতনের বা ফলকের সমান জমিনের উপর ছবি বা নকশা উঁচু উঁচু হয়ে থাকে এমন রিলিফ ওয়ার্ক। এটা বানানোর জন্য প্রথমে কাঁচা মাটি দিয়ে ফলকগুলো তৈরি করে তারপর পুড়িয়ে নেওয়া হয়। তাই এগুলোকে বলে পোড়ামাটির ফলক। বগুড়ার মহাস্থানগড়ে তথা প্রাচীন পুন্ড্র নগরীর প্রত্নতাত্ত্বিক খননে বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রাচীনতম ফলকচিত্র পাওয়া গেছে।
মহাস্থানগড়ের এবং দিনাজপুরের কান্তজীর মন্দিরের ফলকচিত্রের বিষয়বস্তু নরনারী ও দেবদেবী। অন্যদিকে পাহাড়পুর ও কুমিল্লার ময়নামতির ফলকগুলোতে তৎকালীন সমাজ ও নিসর্গের ছবি পাওয়া যায়। বাঘা মসজিদের বা টাঙ্গাইলের আদিনা মসজিদের ফলকচিত্রের বিষয়বস্তু ফুল, লতাপাতা ও জ্যামিতিক নকশা। কিন্তু বর্তমানে আধুনিক বিভিন্ন বিষয় ও আকৃতি নিয়ে টেরাকোটা তৈরি হচ্ছে। বিভিন্ন অফিস ও বাসাবাড়ির অভ্যন্তরীণ সাজসজ্জা ও ভবনের বাইরের সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য এখন প্রচুর টেরাকোটা ব্যবহার করা হচ্ছে।
Read more